বৃহস্পতিবার, ০৭ নভেম্বর ২০২৪, ০৫:৫৩ পূর্বাহ্ন
প্রতিদিন ডেস্কঃ
কোটা বাতিলের দাবির প্রতি সাধারণ শিক্ষার্থীদেরও ব্যাপক সমর্থন আছে। ফলে বিষয়টির যৌক্তিক সমাধান করা না গেলে এই আন্দোলন সারা দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা করেছে পুলিশ সদর দফতর। সরকারি চাকরিতে চলমান কোটাবিরোধী আন্দোলন নিয়ে পুলিশ হেড কোয়ার্টার্সের গোপন প্রতিবেদনে এভাবেই সরকারকে সতর্ক করা হয়েছে।
একই সঙ্গে সমস্যা সমাধানে সরকারকে ১১ দফা সুপারিশ ও ১৩টি পর্যবেক্ষণ দিয়েছে পুলিশ হেড কোয়ার্টার্স।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে করা এ গোপনীয় প্রতিবেদন ইতোমধ্যে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে জমা দিয়েছে পুলিশ সদর দফতর। এদিকে গতকাল সরকারি চাকরির প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণিতে মুক্তিযোদ্ধা কোটা পদ্ধতি বাতিলের সিদ্ধান্ত অবৈধ ঘোষণা করে হাই কোর্টের রায় আপাতত বহাল রেখেছেন আপিল বিভাগ। ঢাকাসহ দেশের অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আন্দোলন অব্যাহত আছে। গতকালও শাহবাগ বন্ধ ছিল কয়েক ঘণ্টা।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে জমা দেওয়া গোপনীয় ওই প্রতিবেদনে ‘হাই কোর্ট কর্তৃক মুক্তিযোদ্ধা কোটা বাতিলের পরিপত্র অবৈধ ঘোষণার প্রতিবাদে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন সংক্রান্ত বিশেষ প্রতিবেদন’ শিরোনামে পুলিশ সদর দফতর বলেছে, ‘২০১৮ সালে কোটা সংস্কার আন্দোলনের সময় সরকারি দলের কোনো কোনো নেতার মন্তব্যে সাধারণ শিক্ষার্থীদের মাঝে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছিল। শিক্ষার্থীদের যে কোনো ধরনের আন্দোলন একটি স্পর্শকাতর বিষয় হওয়ায় সরকারের দায়িত্বশীল ব্যক্তিবর্গের মন্তব্য প্রদানের ক্ষেত্রে অধিকতর সতর্কতা অবলম্বনের প্রয়োজন। ’ শিক্ষার্থীরা আন্দোলনের নামে বিশৃঙ্খলা করলে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্রলীগ বাধা দিতে পারে এতে উভয়পক্ষে অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা ঘটার আশঙ্কা রয়েছে। এতে অতীতের মতো দায়ভার ছাত্রলীগের ওপর চাপিয়ে কোটা আন্দোলন তীব্র আকার ধারণ করতে পারে।
প্রতিবেদনে সরকারকে ১১ দফা সুপারিশ করেছে পুলিশ হেড কোয়ার্টার্স। বলা হয়েছে : ১. ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস ও সন্নিহিত এলাকা, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের বড় বড় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ এবং গোয়েন্দা নজরদারি বৃদ্ধি। ২. সরকারবিরোধী চক্র ও স্বার্থান্বেষী মহল যাতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার সুযোগ না পায় সে ব্যাপারে সতর্কতা বৃদ্ধি। ৩. আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারীসহ সরকারবিরোধী ছাত্র সংগঠন বিশেষ করে ছাত্রদল, ছাত্রশিবির, ছাত্র অধিকার পরিষদ ও বাম ছাত্র সংগঠনের নেতৃবৃন্দের গতিবিধির প্রতি নজরদারি। ৪. ‘মুক্তিযোদ্ধা সংসদ সন্তান কমান্ড’ ও সাধারণ শিক্ষার্থীরা যাতে আন্দোলনে মুখোমুখি অবস্থানে না যায় সে ব্যাপারে সতর্কতা বৃদ্ধি।
৫. শিক্ষার্থীদের চলমান আন্দোলনের ব্যাপারে ছাত্রলীগ নেতা-কর্মীদের সতর্ক অবস্থান নিশ্চিতকরণ এবং কোনোরূপ অনাকাক্সিক্ষত ঘটনায় না জড়ানোর জন্য নির্দেশনা প্রদান। ৬. সড়ক-মহাসড়কে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে শিক্ষার্থীদের যে কোনো ধরনের কর্মসূচি পালন রোধ এবং যান চলাচল স্বাভাবিক রাখতে ফোর্স মোতায়েন। ৭. মোতায়েনকৃত ফোর্সের যথাযথ ব্রিফিং এবং যে কোনো ধরনের উসকানিতেও সর্বোচ্চ পেশাদারিত্বের সঙ্গে দায়িত্ব পালন নিশ্চিতকরণ। ৮. সরকারের দায়িত্বশীল ব্যক্তিবর্গের মন্তব্য প্রদানের ক্ষেত্রে অধিকতর সতর্কতা অবলম্বন। ৯. শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে বহিরাগতদের অনুপ্রবেশ রোধে নজরদারি বৃদ্ধি। ১০. সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অপপ্রচার ও গুজব রোধে সাইবার প্যাট্রোলিং জোরদার। ১১. সব গোয়েন্দা সংস্থার সমন্বিত নজরদারি বৃদ্ধি করা।
প্রতিবেদনে বলা হয় ‘২০১৮ সালে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে সব সরকারি দফতর, স্বায়ত্তশাসিত/আধা-স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান এবং বিভিন্ন করপোরেশনের চাকরিতে সরাসরি নিয়োগের ক্ষেত্রে কোটাপদ্ধতি সংশোধন করে এক পরিপত্র জারি করা হয়। কিন্তু গত ৫ জুন হাই কোর্ট উক্ত পরিপত্র অবৈধ ঘোষণা করে মুক্তিযোদ্ধা কোটা বহাল রাখার আদেশ প্রদান করেন। এ আদেশের প্রতিবাদে ও চাকরিতে সব ধরনের কোটা বাতিলের দাবিতে সাধারণ শিক্ষার্থীদের ব্যানারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে সাধারণ শিক্ষার্থীদের ব্যানারে আন্দোলন শুরু হয়। কোটা বাতিলের দাবির প্রতি সাধারণ শিক্ষার্থীদের সমর্থন থাকায় বিষয়টির যৌক্তিক সমাধান করা না গেলে কোটা বাতিলের এ আন্দোলন সারা দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। ’ আন্দোলনের বিষয়ে পর্যবেক্ষণে বলা হয়েছে, ‘২০১৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ সারা দেশের শিক্ষার্থীরা সরকারি, আধা সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের নিয়োগে কোটা ব্যবস্থার সংস্কারের দাবিতে তীব্র আন্দোলন গড়ে তোলে। সে সময় কোটা সংস্কার দাবির আন্দোলনের প্রতি সাধারণ শিক্ষার্থীদের ব্যাপক সমর্থন লক্ষ্য করা যায়। বর্তমান প্রেক্ষাপটে এই আন্দোলনে স্বল্প সংখ্যক শিক্ষার্থীর অংশগ্রহণ লক্ষ্য করা গেলেও যথাযথ পদক্ষেপ গৃহীত না হলে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আন্দোলনে শিক্ষার্থীদের সম্পৃক্ততা বৃদ্ধি পেতে পারে। ফলে এই আন্দোলন সারা দেশের সব বিশ্ববিদ্যালয়সহ বড় বড় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে ছড়িয়ে পড়তে পারে। ’ প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ করা হয় যে, ‘বিএনপি ও সমমনা দলগুলো দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন পরবর্তী আন্দোলন গড়ে তুলতে নানা প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু তারা বিভিন্ন ইস্যুতে ডাকা কর্মসূচিগুলোতে সাধারণ মানুষের সম্পৃক্ততা ঘটাতে ব্যর্থ হয়েছে। ফলে তারা নেতা-কর্মীদের মনোবল চাঙা ও সরকারবিরোধী আন্দোলন গড়ে তুলতে শিক্ষার্থীদের চলমান আন্দোলনকে রাজনৈতিক আন্দোলনে রূপান্তরিত করার অপপ্রয়াস চালাতে পারে। তারা শিক্ষার্থীদের আন্দোলনকে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অপপ্রচার চালিয়ে বা গুজব ছড়িয়ে সারা দেশে আন্দোলন গড়ে তোলার অপচেষ্টা চালাতে পারে। কোটা সংস্কার আন্দোলনের সময় ডাকসুর সাবেক ভিপি নুরুল হক নূর ‘বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদ’ গঠন করে নেতৃত্ব দান করেন। পরবর্তীতে তাঁর নেতৃত্বে ‘বাংলাদেশ ছাত্র অধিকার পরিষদ’ গঠিত হয়। চলমান আন্দোলনেও ছাত্র অধিকার পরিষদের সাবেক নেতা আখতার হোসেনের নেতৃত্বে গঠিত স্বতন্ত্র ছাত্র সংগঠন ‘গণতান্ত্রিক ছাত্রশক্তি’-এর সদস্য রিফাত রশিদ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার আহ্বায়ক আসিফ মাহমুদ সজীব, ছাত্র অধিকার পরিষদের কেন্দ্রীয় সভাপতি বিন ইয়ামিন মোল্লা, সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের সাবেক নেতা হাসান আল মামুন প্রমুখকে নেতৃত্ব দিতে দেখা যাচ্ছে। তারা কোটা সংস্কার আন্দোলনের ন্যায় বর্তমান আন্দোলনকেও সাধারণ শিক্ষার্থীদের মাঝে ছড়িয়ে দিয়ে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে তীব্র আন্দোলন গড়ে তোলার চেষ্টা চালাচ্ছে। ’ প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ করা হয় যে, ‘কোটা বাতিলের আন্দোলনটি শিক্ষার্থীদের নিকট অত্যন্ত জনপ্রিয় হওয়ায় ছাত্রদল, ছাত্রশিবির ও বিভিন্ন বাম ছাত্র সংগঠনের পাশাপাশি ছাত্রলীগের পদ-পদবি বঞ্চিত কিছু নেতা এই আন্দোলনের পেছনে রয়েছে বলে জানা গেছে। ফলে তারা এবং ছাত্রলীগের অপেক্ষাকৃত কম পরিচিত কিছু নেতা-কর্মী আন্দোলনে যুক্ত হয়ে আন্দোলন জোরদার করার চেষ্টা চালাতে পারেন। ছাত্রদল, ছাত্রশিবির, বাম ছাত্র সংগঠনসহ সরকারবিরোধী বিভিন্ন সংগঠনের নেতা-কর্মী ও সমর্থকরা শিক্ষার্থীদের চলমান আন্দোলনকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করতে সাধারণ শিক্ষার্থীদের সঙ্গে যোগ দিয়ে পরিকল্পিতভাবে কোনো নাশকতা বা শিক্ষার্থী হত্যার ঘটনা ঘটিয়ে তার দায় সরকারের ওপর চাপানোর অপচেষ্টা চালাতে পারে। ’ বিস্তারিত প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, ‘বিএনপি-জামায়াত ও সমমনা দলগুলোর নেতা-কর্মী এবং কথিত সুশীল সমাজ ও বুদ্ধিজীবী বিভিন্ন প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় কিংবা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে সরকারবিরোধী বক্তব্য প্রদান করে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনকে উসকে দিতে পারে। ’