শুক্রবার, ২৪ জানুয়ারী ২০২৫, ০১:৩১ পূর্বাহ্ন
মোঃ নিয়ামুল কবির,অধ্যক্ষ
নবযুগ কলেজ(কুশুরা,ধামরাই-ঢাকা)
শবে-মেরাজ, লাইলাতিম মোবারাকাত বা শবে-বরাত, শবে-কদর এবং জুমআ-এর রাত্রিগুলো বছরের সেরা রাত্রি। তবে ইয়াওম বা দিন হিসেবে শুক্রবার অন্যতম।
আমাদের মনে এ রকম প্রশ্ন উদয় হওয়া স্বাভাবিক যে, শুক্রবার নামকরনের স্বার্থকতা কি? অথবা এর কোন ঐতিহাসিক পটভূমি আছে কিনা ইত্যাদি। এ সমূদয় কৌতূহলের মীমাংসা মেলে বড় পীর হযরত আবদুল কাদের জিলানী (রহঃ) রচিত গুনিয়াতুত্ ত্বালিবীন গ্রন্থের ২য় খন্ডের জুমআর দিন (শুক্রবার)-এর ফজীলত অধ্যায়ে। বড় পীর (রহঃ)-এর বরাত দিয়ে আরও জানতে পারি, শায়খ আবু নসর হযরত আনাস ইবনে মালেক (রাঃ) হতে সনদ পরম্পরায় বর্ণনা করেন যে, আল্লাহর রাসুল (সাঃ) বলেন, “একদা ফেরেশতা হযরত জিব্রাঈল (আঃ) একটি সাদা পালক হাতে আমার নিকট আগমন করেন। উক্ত পালকের গায়ে একটি কালো দাগ ছিল। আমি জিজ্ঞাসা করলাম, আপনার হাতে এটা কি? তিনি প্রত্যুত্তর করলেন, এটা শুক্রবার। এ দিবসে আপনার জন্য বহু পূণ্য জমা রয়েছে। আমি জিজ্ঞাসা করলাম, কালো দাগ কেন? জিব্রাঈল (আঃ) আওয়াজ দিলেন, এটা কিয়ামত। মুদ্দাকথা, শুক্রবারেই কিয়ামত অনুষ্ঠিত হবে। অন্যান্য সকল দিবসের তুলনায় শুক্রবার সর্বেসর্বা। আমাদের পরিভাষায় আমরা এ দিনকে ইয়াওমূল মাযীদ বা অতিরিক্ত পুরস্কার প্রাপ্তির দিন বলে আখ্যা দিয়ে থাকি। ফেরেশতারা এ দিনকে এ নামেই ডেকে থাকেন। এ দিনেই জান্নাতবাসীরা আল্লাহ তাআলাকে দেখতে পাবেন। বর্ণিত আছে, প্রতি জুমআর দিন আল্লাহ তাআলা ছয় লাখ লোক জাহান্নাম থেকে মুক্ত করে দেন। মহান সৃষ্টিকর্তার তরফ হতে অসংখ্যা নেয়ামত, ফজিলত ও বরকতময় উপঢৌকন দিয়ে সাজানো হয় বেহেস্তের মরুদ্যান, সেখানকার অধিবাসী হবেন শুক্রবার জুমআর নামাজ সুসম্পন্নকারীগণ।
শায়খ আবু নসর সনদ পরম্পরায় হযরত সালমান ফারসী (রাঃ) হতে বর্ণিত তিনি বলেন যে, হুজুরে পাক্ (সাঃ) আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন, হে সালমান! বলতে পার কি জুমআর দিনটির নাম জুমআ কেন হল? আমি বললাম, ইয়া রাসুলুল্লাহ (সাঃ) তাতো বলতে পারি না। হুজুর (সাঃ) এরশাদ করলেন, ঐ দিন বাবা আদম (আঃ) এর দেহ তৈরির খামীর (চার উপাদান যথা-মাটি, পানি, বাতাস ও আগুন মিশ্রিত মন্ডা) জমা (একত্রিত) করা হয়েছিল বলে ঐ দিনটির নাম জুমআ রাখা হয়েছে।
কোন কোন রেওয়ায়েতে বিদ্যমান, জুমআ শব্দটি এজতেমা শব্দ হতে চয়ন করা হয়েছে। কোন কোন ঐতিহাসিক রেওয়ায়েত করেন যে, সৃষ্টির পর আদি পিতা হযরত আদম (আঃ) ও আদি মাতা হযরত হাওয়া (আঃ) সর্বপ্রথম দুজনের সাক্ষাতের দিবসটি জুমআ হিসেবে পরিচিত। কোন কোন বর্ণনায় এসেছে, আদি পিতা ও আদি মাতা দুজনার দীর্ঘ বিচ্ছেদের পর আরাফার ময়দানে যে মিলন ঘটে সেটিও জুমআ বার হিসেবে খ্যাত। সর্বশেষে, এখন আমরা যা লক্ষ্য করে থাকি তাহল শহর ও গ্রামাঞ্চলের সকল মুসলিমগণ সপ্তাহের একটি বিশেষ দিনে একত্রিত হয়ে নামাজ আদায় করেন, এ দিনটিও সবার নিকট জুমআ বার হিসেবে পরিচিত। পরিশেষে, এ দিনটিতে কিয়ামত সংঘটিত হবে বলেই এর নাম হয়েছে ইয়াওমে জুমআ। কারন হল, কিয়ামত দিবসটি সকল মানব জাতির একত্রিত হওয়ার দিন হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে মহান রাব্বুল আলামীন বলেন-“ইয়াওমা ইয়াযাউকুম্ লিইয়াও মিজ্জায় যালিকা ইয়াও মুত্তাগাবুনঃওয়া মাইয়্যুমিন বিল্লাহি ওয়া ইয়া’মাল সালিহাইয়্যু কাফ্যির আনুহু সায়্যিআতিহি ওয়া ইয়দ খিলহু জান্নাতিন্ তারি-মিন তাহতিহাল আনহারু খালিদিইনা ফিইহা- আবালান যা-লিকাল ফাওজুল আযীম”
অর্থ:- “যে দিন তোমাদিগকে এ সমবেত হওয়ার দিবসে একত্রিত করবেন, ইহাই লাভ-লোকসানের দিন;আর যে আল্লাহর প্রতি ঈমান। আনিবে এবং নেক কাজ করিবে, আল্লাহ্ মোচন করিয়া দিবেন, তাহার গুনাহসমূহ এবং তাহাকে এমন উদ্যানে দাখিল করিবেন, যাহার নিম্নদেশে নহরসমূহ বহিবে, যেখানে তাহারা সর্বদা অবস্থান করিবে; ইহা বিরাট সফলতা”
সুরা তাগাবুন ৬৪, আয়াত: ৯
আবদুল্লাহ ইবনে মানযার হতে বর্ণিত তিনি বলেন, দয়াল রাসুলে পাক (সাঃ) বলেছেন, শুক্রবার অন্যান্য দিনের সর্দার। অন্যান্য দিন অপেক্ষা এ দিন আল্লাহতায়ালার নিকট অধিক মর্যাদা সম্পন্ন। এমনকি ঈদের দিন অপেক্ষাও এ বেশী বোযর্গ। আল্লাহতায়ালা শুক্রবারকে ৫ টি বোযগী দান করেছেন। যেমন-
০১. এ দিবসে হযরত আদম (আঃ) কে সৃষ্টি করা হয়েছে।
০২. তাঁকে দুনিয়াতে পাঠানো হয়েছে।
০৩. তিনি এ নশ্বর পৃথিবী ত্যাগ করেছেন।
০৪.এ দিনের বিশেষ একটি সময়ে হারাম বস্তু ব্যতিত মু’মিন ব্যক্তির সকল প্রার্থনাই আল্লাহ কবুল করে থাকেন।
০৫. বিশ্ব ভূবন বিলীন হবে।
ইমাম গাজ্জালী (রহঃ)-এর আল-মুরশিদুল আমীন কিতাবের এক বর্ণনায় পাওয়া যায় যে, জুমআর দিনের বিশিষ্ট কয়েকটি সময় হচ্ছে, ডুবেহ ছাদেক হতে শুরু করে সূর্যোদয় পর্যন্ত। সূর্যোদয়ের পর হতে এক প্রহর বেলা পর্যন্ত, দ্বিপ্রহরে সূর্য স্থির হয়ে যাওয়ার পর হতে শুরু করে পশ্চিম দিকে কিছুটা হেলে যাওয়া পর্যন্ত। সূর্যের রশ্মী ম্লান হয়ে যাওয়ার সময়টি অর্থাৎ সূর্যাস্ত হওয়ার পূর্ব মুহূর্তটি। এ সময়গুলোর জন্য পূর্ব হতেই বিশেষভাবে প্রস্তুত থাকা জরুরি। এ সময় বেশী করে দরুদ পাঠ করার নির্দেশ আছে।
রাসূলে খোদা (সাঃ) বলেছেন- “মনোরম রাত্রি এবং সুন্দর দিনে আমার উপর সবচেয়ে বেশী দরুদ পাঠ করিও।” এখানে মনোরম রাত্রি দ্বারা বৃহস্পতিবার দিবাগত রাত্রি এবং সুন্দর দিন বলতে শুক্রবার দিনকে বুঝানো হয়েছে।
ইমাম গাজ্জালী (রহঃ)-এর মুকাশাফাতুল কুলুব বা আত্মার আলোকস্তম্ভ নামক গ্রন্থের-২য় খন্ডে ২৮২ পৃষ্ঠায় বর্ণিত আছে যে, হযরত কাব (রাঃ) বলেন, “সব জনপদের মধ্যে আল্লাহতায়ালা মক্কা শরীফকে, মাস সমূহের মধ্যে রমজানকে, দিন সমূহের মধ্যে জুমআর দিনকে এবং রাত সমূহের মধ্যে কদর এর রাতকে ফজীলত দিয়েছেন। কথিত আছে, জুমআর দিন পক্ষীকূল ও পোকামাকড় একে অন্যের সাথে সাক্ষাত করে এবং বলে, সালাম-সালাম (শান্তি-শান্তি)- এ দিন বরকতময় দিন।”
কোন কোন রেওয়াতে আছে, এ দিবসের সূর্যোদয় অন্যান্য দিনের চেয়ে বেশী উজ্জ্বল দেখায়। এ দিবসে মুসুল্লীগণ যার যার মর্জি মতো তওবা-এস্তেগফার, জিকির-আজগার, ছক্কা প্রদান, নফল ইবাদত, কোরআন তেলাওয়াত, মিলাদ, মোরাকাবা প্রভৃতি ধ্যান-সাধনা করে থাকেন। বর্ণিত আছে, কিতাবধারী সব সম্প্রদায়কেই জুমআর নামাজ দেয়া হয়েছিল, তারা তাতে মতভেদ করে এবং তৎপ্রতি উদাসীনতা প্রদর্শন করে। আল্লাহতায়ালা আমাদেরকে জুমআর নামাজের প্রতি পথনির্দেশ করেছেন এবং এ উম্মতের জন্য এ নামাজ বিলম্বিত করেছেন, এ দিনকে তাদের জন্য ঈদ করেছেন। অতএব জুমআর ব্যাপারে মুসলমানগণ অন্যসব মানুষের চেয়ে অগ্রগামী এবং অবশিষ্ট কিতাবধারী সম্প্রদায় (ইহুদী ও খ্রিস্টান) মুসলমানদের অনুসারী। এ দিন দ্বারা আল্লাহ ইসলামকে সম্মান ও মর্যাদা দিয়েছেন এবং মুসলমানদের জন্য এ দিনটি বিশেষভাবে নির্দিষ্ট করেছেন।
জুমআর দ্যীলত প্রসঙ্গে মহান রাব্বুল আলামীন বলেন-“ইয়া-আইয়্যুহাল্লাযিইনা আমানুও ইযা নুওদিয়া লিস্সালাতি মিইয়াওমিল জুমুআতি ফাছআও ইলা-যিরিল্লাহি ওয়াযারুল বায়আ: যালিকুম খাইরূল্লাকুম ইন্ কুস্তুম্ তা’লামুউন”
অর্থ-“হে মু’মেনগণ। যখন জুমুআর দিনে (জুমুআর) নামাজের জন্য আযান দেয়া হয়, তখন তোমরা আল্লাহর যিকরের দিকে ধাবিত হও এবং ক্রয়-বিক্রয় ত্যাগ কর। ইহা তোমাদের জন্য অধিক উত্তম, যদি তোমাদের কিছু জ্ঞান থাকে।”
সূরা জুমুআ ৬২, আয়াত: ৯
সহায়ক গ্রন্থ:
০১. বঙ্গানুবাদ নূরানী কোরআন শরীফ- মূল: হযরত মাওলানা আশরাফ আলী থানভী (রঃ) তরজমাঃ মাওলানা নূরুর রহমান, এমদাদিয়া লাইব্রেরী, চক বাজার, ঢাকা।
০২. গুনিয়াতুত ত্বালিবীন (১ম ও ২য় খন্ড) অলীকুল শিরমণি গাউসুল আজম বড়পীর হযরত আবদুল কাদের জিলানী (রহঃ) অনুবাদঃ এ.এন.এম. ইমদাদুল্লাহ, ফেন্সী লাইব্রেরী এন্ড ষ্টেশনারী ৬, প্যারিদাস রোড, ঢাকা ১১০০, ২য় সংস্করণ ১৯৯৬ খ্রি. পৃঃ ২০১-২১১।
০৩. আল-মুরশিদুল আমীন-ইমাম গাজ্জালী (রহঃ), অনুবাদ: মাওলানা মুহিউদ্দিন খান, ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ, ৩য় সংস্করণ-১৯৮৬ খ্রি. পৃঃ ৬৩-৬৪।
০৪. মুকাশাফাতুল কুলুব বা আত্মার আলোক স্তম্ভ-২য় খন্ড, ইমাম গাজ্জালী (রহঃ), সোলেমানিয়া বুক হাউস ৭, বাইতুল মুকাররম, ঢাকা ১০০০, প্রথম প্রকাশ- ২০০১ খ্রি. জুন, পৃঃ ২৮০-২৮২।